মহামারিকালে বর্জ্য সংগ্রহকারীদের মধ্যে চরম দারিদ্র্য বেড়েছে

গবেষণায় দেখা গেছে কোভিড মহামারির আগে বর্জ্যশ্রমিকদের মধ্যে চরম দারিদ্র্য ছিল ১৪%। মহামারিকালে তা ৫৬ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ৭০% হয়েছে।

21-12-2021

গবেষণায় আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সব ধরনের কর্মীদের আয়ে প্রভাব পড়েছে। পরিবারের গড় আয় কমেছে ৪১% এবং প্রতি তিনটি পরিবারের অন্তত একজন সদস্য মহামারীর সময় বেকার হয়ে পড়েছেন।

গবেষণায় বলা হয়, "কোভিড-১৯ এর আগে যেখানে ১৪% পরিবার দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থান করছিল সেখানে বর্তমানে ৭০% পরিবার দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করছে"৷

মঙ্গলবার নগরীর ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ এক সেমিনারে এসব তথ্য জানানো হয়।

ব্র্যাক এবং কোকা-কোলা ফাউন্ডেশন পরিচ্ছন্নকর্মীদের সুস্থতা বিষয়ক এক সেমিনারের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা।

সেন্টার ফর ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ইন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং নেটওয়ার্ক-বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (আইটিএন-বুয়েট)-এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক, আলাউদ্দিন আহমেদ এই ফলাফল উপস্থাপন করেন।

সারা দেশে ১০টি সিটি কর্পোরেশনের ৫০০ পরিবারের উপর এই সমীক্ষা চালানো হয়। বিভিন্ন শ্রেণির বর্জ্য সংগ্রহকারী এবং স্যানিটেশন কর্মীদের মধ্যে রয়েছে পিট পরিস্কারক, বর্জ্য সংগ্রহকারী, অজৈব ব্যবসায়ী এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী/সুইপার।

অধ্যাপক আলাউদ্দিন বলেন, কোভিড-১৯-এর আগে ৭৫% পরিবার তিনবেলা পর্যাপ্ত খাবার খেতে পারত, মহামারির সময় এ পরিমাণ ২১%-এ নেমে আসে। আগে ২৫% পরিবার তিনবেলা অপর্যাপ্ত খাবার পেলেও এখন এই পরিমাণ বেড়ে ৪৬% হয়েছে। এখন মাত্র ৩৩% বর্জ্য সংগ্রহকারী এবং স্যানিটেশন কর্মী দুই বেলা খাবার খায়।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৪৬% নারী বর্জ্যশ্রমিক কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা এবং/অথবা অনিরাপদ বোধ করার কথা জানিয়েছেন। ৪৩% নারী জানিয়েছেন, তারা নিয়মিত মজুরি পান না অথবা কম পান কিংবা বকেয়া থাকে। প্রায় ৩৮% নারী বর্জ্যশ্রমিক পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন। ৩৭% নারী কর্মী ঘরের কাজের জন্য কোনো ধরনের স্বীকৃতি পান না বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য সংসারের কাজে সাহায্য করেন না। আর ১৭.৫% নারী বর্জ্যশ্রমিক ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে সমস্যায় পড়েন। তাদের মধ্যে প্রায় ১৬% কর্মী মাসিকের সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সমস্যায় পড়েন।

গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, প্রায় ৫৯% শ্রমিক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

কোভিড-১৯ চলাকালে প্রায় অর্ধেক বর্জ্যশ্রমিক (৪৮%) ও তাদের পরিবারের সদস্যদের (৪২%) করোনার উপসর্গ দেখা দেওয়ায় ঝুঁকি আরও বেড়েছে। কাজের জন্য তাদেরকে বিভিন্ন এলাকায় যেতে হয় এবং উচ্চ স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে হয়। এতে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বাড়ে।

সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, লকডাউন চলাকালীন এই পেশার মানুষকে জরুরি সেবা প্রদানকারী হিসেবে শ্রেনীভুক্ত করা হলেও তাদের ঝুঁকি এবং অবদানের কথা প্রচার পায়নি। এই সম্প্রদায়কে নানা কারণে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনা চ্যালেঞ্জিং। অন্যতম কয়েকটি কারণ হলো: এ সম্প্রদায়ের আকার, স্বল্প আয় এবং আয়ের অনিশ্চয়তা, মাদকাসক্তি এবং নিজেদের আনুষ্ঠানিক সংগঠনের অভাব।

প্রায় ৪ লাখ বর্জ্য সংগ্রহকারী ঢাকায় প্রতিদিন ৪৭৫ টন বর্জ্য রিসাইকেলে অবদান রাখে (উৎপাদিত বর্জ্যের ১৫%)। অধিকাংশ শ্রমিকের বয়স ২৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে নারীরা বেশিরভাগ রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজে নিয়োজিত

সাধারণত, শ্রমিকদের কাজের সময় ছিল ৫-৮ ঘন্টা, তবে তারা প্রয়োজন অনুযায়ী করে কাজ করে থাকেন, তাই কখনও কখনও রাতেও তাদের কাজ করতে হয়।

নিউ ক্লিন ঢাকা মাস্টার প্ল্যান (২০১৮-২০৩২) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ৬৩.২৮% খাদ্য বর্জ্য, কাগজ ৯.৬৪%, প্লাস্টিক ৮.৮৪%, ঘাস/কাঠ ৬.৫৭%, বালি/পাথর ৫.৮৩%, টেক্সটাইল ৪.২২%, রাবার/চামড়া ০.৩৬%, ধাতব পদার্থ ০.৫৯% এবং অন্যান্য ০.৬৮%।

সেমিনারে ঢাকা শহরের বর্জ্যশ্রমিকদের নিরাপদ জীবন ও জীবিকার জন্য একটি মডেল তৈরির লক্ষ্যে "বন্ধন" নামক প্রকল্পের ফলাফল তুলে ধরা হয়। ব্র্যাক আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এবং কোকা-কোলা ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে, কমিউনিটি সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে দেওয়া একটি উপযোগী পরিষেবা প্যাকেজের মাধ্যমে ঢাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ৩,৫০০ জন মানুষের সুস্থতার লক্ষ্যে পাইলট প্রকল্প 'বন্ধন' বাস্তবায়ন করছে।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা অত্যন্ত প্রান্তিক এবং সামাজিকভাবে উপেক্ষিত।

তাদের জীবন ও জীবিকা উন্নত করার জন্য যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন। উপার্জন, জীবনমানের অবস্থা, মৌলিক অধিকার, সামাজিক অবস্থান, নিরাপত্তা, সাংগঠনিক এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের জন্য আরও বেশি বেশি এবং দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন যে, পুরো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইকোসিস্টেমের পুনর্গঠনের জন্য শক্তিশালী নীতিমালা প্রণয়ন এবং পদক্ষেপ ছাড়া টেকসই পরিবর্তন সম্ভব হবে না।

সেমিনারে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সেলিম রেজা বলেন, "আমরা একটি অংশগ্রহণমূলক এবং উদার সমাজ গড়ে তুলতে চাই যেখানে আমাদের শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য যারা কঠোর পরিশ্রম করেন তাদের জীবনকে উন্নত করতে আমরা একসাথে কাজ করে যাব। আমরা বর্জ্যশ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতির জন্য এই সেমিনার থেকে প্রাপ্ত তথ্য কাজে লাগানোর জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করব।"